কক্সবাজার প্রতিনিধি »
কক্সবাজার সদরের আওতাধীন ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলন ১২ নভেম্বর সম্পন্ন হয়। একইদিন কাউন্সিলও সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান কর্তৃক ব্যালট ছিনতাই কান্ডের কারণে শেষ করা যায়নি কাউন্সিল। বরং জেলার শীর্ষ নেতার এমন কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে টানা ২ ঘণ্টা প্রধান সড়ক অবরুদ্ধ করে রাখেন সম্মেলনের কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীরা। পরে পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিলেও পথসভা, বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিক্ষুব্ধরা। ফলে, সম্মেলন শেষ হলেও নতুন কমিটি ছাড়াই ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল পণ্ড হয়।
এদিকে, এঘটনার পর থেকে ঝুলে থাকা কমিটির নেতা হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন মাদকসহ নানা অপকাণ্ডে বিতর্কিত চিহ্নিত অপরাধীরা। যেকোন মূল্যে তারা আওয়ামী লীগে পদ দখলের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নানা অপরাধকাণ্ডে আয় করা অটেল সম্পদ ও নিজেকে রক্ষা করতে কোটি টাকার মিশনে ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে ত্যাগী ও পরিচ্ছন্নদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন বিতর্কিতরাও উপজেলা-জেলা নেতাদের কাছে ছুটছেন বলে প্রকাশ পেয়েছে। এদের মাঝে অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, মাদক ব্যবসা, এলাকায় আদিপত্য বিস্তার, জামায়াত বিএনপির সাথে সখ্যতা, অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ড থেকে বার্তা এসেছে, সৎ-যোগ্য-সমাজে সমাদৃত, পারিবারিকভাবে আওয়ামী পরিবারের সন্তান হবেন এমন ব্যাক্তিকে সম্মেলনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত করা হবে। বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার সাথে জড়িত কাউকে যেন মূল্যায়ন করা না হয়।
কিন্তু বর্তমানে ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ প্রত্যাশী হেলাল জেলা শ্রমিকলীগ সভাপতি জহিরুল হক সিকদার হত্যা মামলার আসামী। তার নেতৃত্বে জহির হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। এটা ছাড়াও তিনি কোন দিন আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে দুদক মামলা করেছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামীলীগের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের বউয়ের ভাই হিসেবে ঝিলংজা ইউনয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে মরিয়া তিনি।
সভাপতি পদে অন্য প্রার্থী সদ্য সাবেক সভাপতি সরোয়ার আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলার অভিযোগ না থাকলেও তিনি ‘নয় ভালো-নয় মন্দ’ টাইপের লোক। তদবির করার মতো কোন ক্ষেত্র না থাকায় কাউন্সিলেই ভরসা ছিল তার।
অন্যদিকে, সাধারণ সম্পাদক হতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন অস্ত্র, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও একাধিক ইয়াবা মামলার আসামি সদর উপজেলার খরুলিয়ার পূর্ব মোক্তারকুল এলাকার দানু মিয়ার ছেলে দিদারুল আলম। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম মিলে রয়েছে একাধিক মামলা বিচারাধীন। ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছেন দুই বার।
ফের সাধারণ সম্পাদক হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন লিংকরোড এলাকার কিং হিসেবে পরিচিত সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদরত উল্লাহ। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সরকারি পাহাড় দখল-কাটা, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিয়ে বাহিনী তৈরীসহ অভিযোগ অঢেল। তার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষদের নানা ভাবে জিম্মি করে তার বাহিনীর চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, লিংক রোড এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে কুদরত গ্রুপ সক্রিয় ছিল। যার জেরেই গত ইউপি নির্বাচনের আগে লিংক রোডে তার ব্যক্তিগত অফিসে দুর্বৃত্তরা গুলি করেছিল। এতে তার বড় ভাই জেলা শ্রমিকলীগ সভাপতি জহিরুল ইসলাম নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন কুদরত উল্লাহ।
অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মুহাম্মদ আলমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ না থাকলেও গ্রামে জামায়াতি সিন্ডিকেটের সাথে একীভূত হয়ে খ্যাতনামা খরুলিয়া বাজার থেকে কোটি টাকা রাজস্ব লুটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জামায়াত ঘেষা খরুলিয়ায় একমাত্র আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের পর ধারাবাহিক ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে থাকায় সরকারি দলের কর্মী হিসেবে এলাকায় তার পুরো পরিবারের একটি প্রভাব রয়েছে। বাজারে নির্দিষ্ট দোকান না থাকলেও নিরাপত্তার খাতিরে ব্যবসায়ীরা তাকে মালিক সমিতির সভাপতির পদে রেখেছেন। এ কারণে বাজারের রাজস্ব লুটকারি জামায়াতি সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূলের একাধিক নেতা-কর্মীরা জানান, দল ক্ষমতায় থাকায় সবাই এখন আওয়ামী লীগের নেতা হতে চাচ্ছেন। ঝিলংজা যেহেতু সদরের মূল- এখানে জনবান্ধব নেতা না হলে দলীয় কর্মকান্ডে নেতাকর্মী সমাগম ঘঠিয়ে প্রোগ্রাম সফল করা কষ্টসাধ্য হবে। সভাপতি প্রার্থী হওয়া হেলাল দলের কেউ ছিলেন না। বোন জামাই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তিনি হঠাৎ এসে সভাপতির পদ দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তৃণমূলের সাথে যেহেতু তার যোগাযোগ নেই, সেহেতু তিনি দলের লাভের চেয়ে নিজের লাভের জন্যই বেশি করবেন। তিনি সভাপতির পদ পাচ্ছেন প্রচার পাওয়ায় এলাকার দাগী আসামি, অপরাধীরা ইতোমধ্যে তাকে হাজিরা দেয়া শুরু করেছেন। সেসব অপরাধীরা বিসিক এলাকা, সরকারি কলেজ ও মেডিকেল কলেজের পেছনে পাহাড়ি এলাকার সরকারি জায়গা দখল-বেদখলে এখন থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছে। এসব এলাকা এতদিন সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদরত উল্লাহর লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতো। ক্ষমতার পালাবদল হলে হেলাল হবেন নতুন মোড়ল।
আরেক সভাপতি প্রার্থী সদ্য সাবেক সভাপতি সরোয়ার দলীয় নেতাকর্মীদের সমস্যা সমাধানে সামনে গেলেও কোন দখল-বেখলে কখনো সমর্থন করেন না। এজন্য তাকে অনেকে মৃয়মান নেতা বলেও অবহিত করেন।
তারা আরও জানান, সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদরত উল্লাহ নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে আবারো সাধারণ সম্পাদক পদ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কামিয়ার হতে, ভাই হত্যায় অভিযুক্ত হেলালের সাথে জোট বাঁধার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। একই ভাবে নিজের অপরাধ ও অপকর্ম আড়াল করতে হেলালের সাথে যুক্ত হয়ে সাধারণ সম্পাদক হতে মরিয়া মাদক ও অস্ত্র মামলার আসামী দিদার। অপর প্রার্থী আলম জামায়াত অধ্যুষিত খরুলিয়ার বাসিন্দা হয়েও আওয়ামী রাজনীতি কন্টিনিউ করায় তৃণমূলের ত্যাগীরা তার প্রতি সহানুভূতিশীল।
নিজের প্রার্থীতা ও অপরাধ বিষয়ে দিদারুল আলমের বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। রিং হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদরত উল্লাহ নিজের কোন বাহিনী নেই উল্লেখ করে বলেন, আমি দল ও দলের নেতাকর্মীদের জন্য অতীতে যা করেছি তার মূল্যায়ন করলে আমাকে আবারো দায়িত্ব দিবে এতে সন্দেহ নেই।
অপর প্রার্থী মোহাম্মদ আলম বলেন, আমি বিরোধী দলের সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের দায়িত্বপালন করে নিপীড়নের শিকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শেখ হাসিনার সৈনিক। আজন্ম আওয়ামী লীগ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান ও পরিচ্ছন্ন এবং ত্যাগী হিসেবে তৃণমূলের সবাই আমাকে জানেন। টাকা খরচ করতে না পারলেও আমি মূল্যায়িত হবো বলে আশাবাদী।
অতীতে দলীয় কর্মকান্ডে না থাকলেও হঠাৎ সভাপতি প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বজনরা পদ পেতে অতীত কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়া লাগে নাকি.? আমিও আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান- স্বজন; আমার অতীত নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে? এরপরও বলি ২০১৩ সালেও আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। আমার কোন বাহিনী নেই, হবেও না। আমি আশাবাদী প্রত্যাশিত পদটি পাবো।
কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউর রহমান রেজা বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মাথায় রেখেই বিতর্কিত কাউকে নেতা করা হবে না। ত্যাগী ও তৃণমূলের সাথে সম্পৃক্তদেরই দায়িত্বশীল হিসেবে পদে আনার প্রচেষ্টা রয়েছে।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম মাদু বলেন, সদরের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঝিলংজা ইউনিয়ন। এখানে দায়িত্বে আসতে চাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা চলমান। কিন্তু আদালতের রায়ের আগে কাউকে দোষী বলা সমীচীন নয়। জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদের পরামর্শে এখানকার নেতৃত্ব বাছাইয়ের কাজ চলছে। তবে, ত্যাগীরাই দায়িত্বপাক এটাই আমার চাওয়া।